সিলিকন চিপের বিকল্প
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
মাইক্রোইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিস্কারে চমৎকৃত বর্তমানের বিশ্ব। আর এই আবিস্কারের মূলে রয়েছে সিলিকন চিপ। বিগত কয়েক দশকে সিলিকনের তৈরী মাইক্রো চিপ জয় করেছে ইনফরমেশন এজ বা তথ্যযুগকে। মেইন ফ্রেম কম্পিউটার পার হয়ে পার্সোনাল কম্পিউটার, ল্যাপটপ কম্পিউটার এবং সর্বশেষে সুপার কম্পিউটার প্রযুক্তিতে সিলিকন চিপ যোগ করেছে নতুন মাত্র। ইতোমধ্যেই “ক্রে টি নাইন্টি” এর মত সুপার কম্পিউটার সেকেন্ডে ৬০ বিলিয়ন হিসাব করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। বর্তমানে প্রতি ১৮ থেকে ২৪ মাস অন্তর অন্তর কম্পিউটারের ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে পড়ছে। ফলে সিলিকন চিপগুলো ক্রমশঃই ধাবিত হচ্ছে পয়েন্ট ওয়ান এর বাধার দিকে। সাধারণ হিসাব মতে সিলিকনকে কোনভাবেই পয়েন্ট ওয়ান মাইক্রোনের চেয়ে কম সংকুচিত করা সম্ভব নয়। এই তত্ত্বকেই বলা হচ্ছে পয়েন্ট ওয়ান এর বাধা। কিন্তু পয়েন্ট ওয়ানের এই বাধা অপসারণ ছাড়া কম্পিউটারের ক্ষমতা বৃদ্ধির ধারা অব্যহত রাখা সম্ভব নয়। যদিও এসকল উপায় আবিস্কারের পূর্ব পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের মাল্টিপ্রসেসরের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। যেমন ইন্টেল কর্পোরেশনের আধুনিক কোর-আই-সেভেন প্রসেসরে আটটি প্রসেসর সমান্তরালে কাজ করে কম্পিউটারের বাড়তি গতির সমস্যা সমাধান করছে। মাল্টিপ্রসেসর ভিত্তিক এই সমাধানও অচীরেই সেকেলে হয়ে পড়বে। ফলে আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সিলিকন চিপের বিকল্প কিছু একটা তৈরীর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকদের দেয়া তিনটি সম্ভাব্য উপায় হলো অপটিক্যাল কম্পিউটার, কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং জৈবিক চিপ।
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক অপটিক্যাল কম্পিউটার সম্পর্কে। অপটিক্যাল কম্পিউটারে মুলতঃ সিলিকন মাইক্রোচিপের পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে- লেন্স, আয়না, এবং লেজার রশ্মি। এক্ষেত্রে অপটিক্যাল কিউবের মাঝদিয়ে আলোকরশ্মি ডিজিটাল তথ্য বহন করে আড়াআড়ি ভাবে একে অপরকে অতিক্রম করতে পারবে প্রায় আলোর গতিতে। আমেরিকার বিখ্যাত বেল ল্যাবরেটরিতে ১৯৯০ সালে নির্মিত হয়েছে প্রথম প্রটোটাইপ অপটিক্যাল কম্পিউটার। অবশ্য একটা সিলিকন মাইক্রোপ্রসেসরে যেখানে কয়েক মিলিয়ন ট্রানজিস্টার ব্যবহার করা হয়, সেখানে এই কম্পিউটারে ছিল মাত্র ১২৮ টি অপটিক্যাল ট্রানজিস্টার। তবে সিলিকনের বিকল্প হিসাবে অপটিক্যাল কম্পিউটার, প্রতিযোগীতায় বেশ এগিয়ে আছে।
এবার আসা যাক কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রসঙ্গে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল ভিত হবে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান। বস্তুত কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এখনও অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য। এর প্রধান কারণ পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত প্রায় সকল সূত্রই কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের মতে স্বল্পশক্তির ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের আচরণ প্রবাহ ধারার মত কিন্তু উচ্চ শক্তির ক্ষেত্রে এর আচরণ কণার মত। বিভব পরিবর্তন করে ইলেকট্রনের অনুনাদ সৃষ্টি এবং ধ্বংস করা যায়। আর এভাবেই লোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ করে তৈরী করা সম্ভব বাইনারী বার্তা। কোয়ান্টাম ট্রানজিস্টার এখন আর পদার্থবিদদের কাছে স্বপ্ন নয় বরং বাস্তবেই তা তৈরী করা সম্ভব হয়েছে, তবে এগুলো অতি মাত্রায় সংবেদনশীল এবং কাজের ক্ষেত্রে জটিল হবার কারণে এদের স্থান এখনও গবেষণাগারে।
এবার জেনে নেওয়া যাক জৈবিক চিপের অগ্রগতি প্রসঙ্গে। শুনে অনেকটা অবাক হবার কথা, বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল কম্পিউটারে কোন সিলিকন চিপ নেই। মানুষের মাথাই সেই কম্পিউটার। এ যাবৎ আবিষ্কৃত সকল সুপার কম্পিউটার অপেক্ষা একটা মানুষের ডাটা প্রসেস করার ক্ষমতা কয়েক হাজার গুণ বেশি। তাই ভবিষ্যৎ কম্পিউটারের গতির প্রশ্ন মোকাবেলায় অনেক বিজ্ঞানীদের গবেষনাও জৈবিক কোষকে ঘিরে। মানুষসহ সকল প্রাণী দেহের মূল গঠন উপাদান হচ্ছে জৈব অণুপ্রোটিন। জৈব প্রোটিনের অণুগুলো গতিশীল এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিসরে সদা পরিবর্তনশীল। এই গতিশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে যদি দুইটি অবস্থানিক ধাপ সৃষ্টি করা যায়, তবে একটি অবস্থানিক পর্যায়কে ‘শূণ্য’ এবং অপর পর্যায়কে ‘এক’ দ্বারা সুচিত করে কম্পিউটারের লজিক গেট তৈরী করা সম্ভব। এ ধরণের ডিজিটাল সুইচ কম্পিউটার হার্ডওয়ারকে স্বাভাবিকভাবেই সংক্ষিপ্ত করে আনবে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বেছে নিয়েছেন স্থায়ী, আলোক সক্রিয় ও সহজলভ্য উপাদান ব্যাকটেরিও ডোপসিন। এটি পাঁচ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপমাত্রা সহনশীল। প্রফেসর রবার্ট বার্জ প্রথম লক্ষ্য করেন যে, “হ্যালোব্যাক টেরিয়াম হ্যালোরিয়াম” নামক ব্যাকটেরিয়ার গাঠনিক যৌগে একটিবিশেষ উপাদান রয়েছে যা আলোর প্রভাবে আকার পরিবর্তন করতে পারে আর এই পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রন করেও গতিশীল কম্পিউটার তৈরী করা সম্ভব হতে পারে।
এখন পর্যন্ত সিলিকনের বিকল্প হিসাবে যে সকল প্রযুক্তির কথা বলা হচ্ছে তার সবই সম্ভাবনা, বাস্তবিক নয়। অবশ্য গতিশীল কম্পিউটার পাওয়ার জন্য সিলিকনের একটি বিকল্প অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে। এই হিসাবে বলা যায় আর মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে সিলিকনের জয়যাত্রার ইতিহাস।
সিলিকন চিপের বিকল্প
- Sayed
- Site Admin
- Posts: 558
- Joined: Tue Sep 04, 2018 3:38 pm